সিলেটের দর্শনীয় স্থান বিছানাকান্দি, জাফলং, রাতারগুল, মাধবকুন্ড

সিলেটের দর্শনীয় স্থান

সিলেট বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি বিভাগীয় শহর। সুরমা নদীর তীর ঘেষে গড়ে উঠা এই শহরটি বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই জেলাটি বাংলার পূণ্যভূমি নামেও পরিচিত। সিলেটকে তার ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের জন্য ৩৬০ আউলিয়ার দেশও বলা হয়। এখন প্রশ্ন জাগতেই পারে যে,

সিলেটকে কেন ৩৬০ আউলিয়ার দেশ বলা হয়?

ইতিহাস বলে যে ১২০৩ সালে হযরত শাহ জালাল(রঃ) ইয়েমেন থেকে ৩৬০ জন সঙ্গী সহো এসে অত্যাচারী শাসক গৌর গোবিন্দকে বিতারিত করে দেশে শান্তি ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। তাদের উপর খুশি হয়ে অধিবাসীগন এই ৩৬০ জনকে সম্মানিত করতে সিলেটকে ৩৬০ আউলিয়ার দেশ নামে অভিহিত করেন।

ঐতিহাসিক ভাবে সিলেট যেমন সমৃ্দ্ধশালী ঠিক তেমনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা চিন্তা করলে রাঙ্গামাটি কিংবা বান্দরবানের সাথে সাথে সিলেটের নাম খুব জোরে-শোরেই উচ্চারিত হয়। সিলেট জেলা ও বিভাগ যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের এক অপার লীলাভূমি। এর একদিকে যেমন টিলা,আর চা বাগান,অন্যদিকে পাহার ,পাহাড়ি ঝর্ণা যেকোনো পর্যটকের মন কেড়ে নিতে পারে অনায়াসেই।

সিলেট জেলার দর্শনীয় স্থান নিয়ে লিস্ট করতে বসলে গুনে শেষ করতে পারা ভীষন কঠিন। সাথে যদি পুরো সিলেট বিভাগে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা আর প্রাকৃতিক লীলাভুমি গুলোকে একসাথে চিন্তা করা হয় তবে যে কোনো পর্যটকের জন্য তা ষোল আনা। 

চলুন প্রথমে সিলেট জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো নিয়ে জানা যাকঃ

রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট-সিলেটের দর্শনীয় স্থানঃ

বাংলাদেশের একমাত্র সোয়াম্প ফরেস্ট রাতারগুল। সিলেট জেলার শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার দুরবর্তী গোয়াইনঘাট নামক উপজেলায় এর অবস্থান। প্রায় ৩০,৩২৫ একর জায়গা জুড়ে বিস্তার করা এই সোয়াম্প ফরেস্টের মাত্র ৫০৪ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে প্রায় ২৫ প্রজাতির গাছগাছালি নিয়ে গড়ে উঠা বনভূমি আর বাকী এলাকা জলাশয়ে পরিপূর্ণ। “সিলেটের সুন্দরবন” নামে বিখ্যাত এই বন বছরের ৪-৫ মাস পানির নিচেই অবস্থান করে।

ডুবন্ত এই বনই পর্যটকদের মূল আকর্ষন। নৌকা করে তারা একরের পর একর চষে বেড়াতে থাকেন। প্রকৃতির এই বিরল খাম খেয়ালীর জন্য অনেকে রাতারগুলকে “বাংলার আমাজন” নামে অভিহিত করেন।

বর্ষায় এই বনের গাছে গাছে বাসা বাধে নানা জাতের পাখি,আর বিভিন্ন বন্যপ্রানী আবার শীতকালে এই বনই হয়ে উঠে অতিথি পাখিদের এক নিরাপদ বাসস্থান।

See also  Chrisean Rock Net Worth

সাধারণত জুলাই মাসের শেষ থেকে অক্টোবর মাসের শেষ অবধি সময়কালকে রাতারগুলে ভ্রমনের উপযুক্ত সময় ধরা হয়।

জাফলং

জাফলং “প্রকৃতির কন্যা” নামে পরিচিত দেশের অন্যতম পর্যটন এলাকা। সিলেটের দর্শনীয় স্থান গুলোর মাঝে জাফলং সবার পছন্দের শীর্ষে অবস্থান করে বরাবরই। ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেষা সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় এটি অবস্থিত। 

জাফলং এর দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে রয়েছে বড় আর নুড়ি পাথর দিয়ে সাজানো পিয়াইন নদীর কাচের মতো সচ্ছ ধারা, ঝুলে থাকা ডাউকি ব্রীজ আর সীমান্ত ঘেষা উচু পাহারের উপর খেলা করা তুলোর মতো সাজানো মেঘমালা। যা জাফলং কে করেছে অনন্য। 

সময়ের সাথে সাথে রুপ পালটিয়ে সারা বছরের জন্য সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকর্ষন করে জাফলং।  

বিছানাকান্দি

সিলেটের গোয়াইন ঘাট উপজেলার আরেক ইউনিয়ন রুস্তমপুরে বিছানাকান্দি অবস্থিত। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে অবস্থিত খাসিয়া পাহারের অসংখ্য ছোট বড় ধাপ একত্রিত হয়ে দুইপাশ থেকে মিলিত হয়েছে এই পাথর কোয়ারীতে।  হিমালয় পাহারের কোল ঘেষে নেমে আসা ঝর্ণার বারিধারা দিয়েছে এক অনন্য মাত্রা। 

পাথরের বিছানার মতো বিস্তীর্ন এলাকার উপর দিয়ে বয়ে চলা সচ্ছ জলরাশি আর পাহারের উপরের শুভ্র মেঘের ঘনঘটা পর্যটকদের টেনে নিয়ে যায় বারবার। 

ভোলাগঞ্জ-সিলেট জেলার দর্শনীয় স্থান

সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত দেশের সর্ববৃহৎ পাথর কোয়ারীর এই অঞ্চল। দেশের অন্যতম সাদা পাথরের উৎস এই অঞ্চল। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের উচু উচু পাহার গুলো যেন দেয়াল হয়ে ভোলাগঞ্জকে পরিবেস্টিত করে রেখেছে। পাহারে থাকা সংখ্য ঝর্নাধারা থেকে নেমে আমি পানিই ধলাই নদীকে রাখে চির যৌবনা। 

পাহাড়ি এসব ঝর্ণা ধারার সাথে নেমে আসে রাশি রাশি সাদা পাথর। সেই পাথরের উপর দিয়েই বয়ে চলা ধলাই নদী ভোলাগঞ্জের মূল আকর্ষন।

ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর এলাকাটি দেখতে কিছুটা ব-দ্বী্পের মতো। ধলাই নদিটি বাংলাদেশে প্রবেশের পর দুইটি প্রধান ভাগে বিভক্ত হয়ে পুনরায় মিলিত হয়ে এই অঞ্চল সৃষ্টি করেছে।

পাথর উত্তলন সহজ করার জন্য ১৯৬৯ সালে সোয়া ১১ মাইল দীর্ঘ একটি রোপওয়ে নির্মান করা হয়। ১৯৯৪ সালের পর থেকে যা ব্যবহার অযোগ্য হওয়ায় পরিত্যাক্ত ঘোষনা করা হয়। রোপওয়ে গুলো এখন কালের স্মৃতিচিহ্ন রুপে বিরাজমান।

উৎমাছড়া ও তুরুংছড়া এর পাশেই অবস্থিত। কিন্তু ভরা বর্ষায় যা রীতিমতো বিপদজনক।

লোভা ছড়া

সিলেট জেলার উত্তর-পূর্ব সীমান্তের উপজেলা কানাইঘাট। কানাইঘাটের খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে বয়ে চলা সচ্ছ জলরাশির যে ধারা ,সেটাই লোভাছড়া নামে পরিচিত। সীমান্ত বেষ্টিত সবুজ পাহাড় আর পানির সচ্ছ জলধারা লোভাছড়াকে দিয়েছে এক অনন্য রুপ।

See also  রাজাকার কি, কাকে বলে, কোথা থেকে, কীভাবে এবং কেন?

লোভাছড়ায় রয়েছে ব্রিটিশ আমলের চা বাগান , ব্রিটিশ আমলে (১৯২৫ সাল) নির্মিত ঝুলন্ত সেতু আর খাসিয়া উপজাতিদের গ্রাম। চা বাগান , গাঢ় নীল পাহার আর সচ্ছ নীল জলরাশি মিলে মিশে একাকার এই এলাকায়। 

ঐতিহাসিক অনেক স্থাপনা রয়েছে পুরো লোভাছড়া জুরে। মিরাপিং শাহার মাজার, মোঘল রাজা-রানীদের বিভিন্ন পুরাকীর্তি, সুপ্রাচীন দিঘী, খাসিয়া পল্লী, পাথর কোয়ারী সহো দিগন্ত বিস্তৃত চা বাগান। লোভা ছড়ার বনে দেখা মেলে বন মোরগ,খরগোশ আর হরিন।

লোভাছপড়া ভ্রমনের উৎকৃ্স্ট সময় ঝুম বর্ষায় বা শীতকালে।

বর্ষায় চা বাগান আর বন হয়ে উঠে সবুজ আর নদী হয়ে উঠে পূর্ন যৌবনা আর শীতকালে কুয়াশার চাদর এক স্বপ্নের জগত তৈ্রী করে।

হজরত শাহজালাল(র) এর মাজার

সিলেট ৩৬০ আউলিয়ার দেশ তথা পূন্যভুমি। সিলেটের মাটিয়ে চির নিদ্রায় শায়িত হওয়া পীর আউলিয়াদের মধ্যে হজরত শাহজালাল (র) অন্যতম। সকল ধর্মের মানুষের কাছে সমান ভাবে সমাদৃত এই মহান ব্যক্তির মাজারে সারা বছর মানুষের ঢল লেগে থাকে। 

মাজারে উত্তর দিকে রয়েছে বিরাট এক পুকুর। পুকুর জুড়ে খেলা করে বেড়ায় অসংখ্য গজার মাছ। বলা হয় যে , হজরত শাহজালাল(র) সাথে করে এই গজার মাছ গুলো নিয়ে এসেছিলেন। তাছাড়াও রয়েছে সোনালী রুপালী মাছের একটি কূপ। 

বিখ্যাত জালালী কবুতর এই মাজারে সারাক্ষন উড়তে দেখা যায়। যাদের সংখ্যা হয়তো গুনে শেষ করা যাবেনা। 

এছাড়াও হজরত শাহজালালের ব্যাবহৃত থালা-বাসন, তলোয়াড়, প্রার্থনা কক্ষ রয়েছে ।

পবিত্র স্থানটি একদিকে যেমন আধ্যাত্মিক দিক থেকে সমাদৃত অন্যদিকে ঐতিহাসিক ভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

সংগ্রাম্পুঞ্জি ঝর্ণা

জাফলং জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র ১৫-২০ মিনিটের দুরত্বে অবস্থিত সংগ্রাম্পুঞ্জি ঝর্ণার স্থানীয় নাম “মায়াবী ঝর্ণা”। মায়াবী ঝর্ণা ভারতের সীমান্তে অবস্থান করায় ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ এর প্রহরায় বাংলাদেশীরা সেখানে ভ্রমণ করতে পারেন। পাহাড়ের গা বেয়ে চলা ঝর্ণার জলধারা তৈ্রী করেছে পুকুরের ন্যায় জলাধার। ৩ টি আলাদা ধাপে গড়ে উঠা এই ঝর্ণার প্রতিটি ধাপ ভ্রমন পাগল মানুষদের টানে চুম্বকের মতো। এর তিন নাম্বার ধাপে রয়েছে সংখ্য নাম না জানা গুহা আর সুড়ঙ্গ। যে পথের হদিস আজো অজানা। তাই ভ্রমন পিপাসুদের জন্য এ এক স্বর্গ রাজ্য।

লাক্কাতুরা চা বাগান

সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর থেকে উত্তর দিকে প্রায় ১২৯৩ হেক্টর জমির উপর বিস্তৃত এই চা বাগান। উচু-নিচু অনেক পাহাড় আর দিগন্ত বিস্তৃত এই চা বাগান বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম চা বাগান। ্প্রতি বছর প্রায় ৫ লক্ষ কেজি চা পাতা উৎপাদিত হয় এই চা বাগান থেকে। 

See also  মারা গেছেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা

এই চা বাগানের একদিকে এয়ারপোর্ট অন্যদিকে রাবার বাগান আর চায়ের ফ্যাক্টরী। চা বাগানের মাঝেই রয়েছে কমলা, ট্যাং ফল সহো নানা ফলের গাছ।

তামাবিল

সিলেটের দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো তামাবিল। রবি ঠাকুরের দেয়া উপাধি “সুন্দরী শ্রীভুমি” সিলেটের এক অনন্য দর্শনীয় স্থান জৈন্তাপুর উপজেলায় অবস্থিত তামাবিল।

জাফলং থেকে পুর্বে ৫ কিলোমিটার গেলেই অনন্য সুন্দরী  তামাবিলের দেখা পাওয়া যাবে।

তামাবিলের একদিকে অন্যদিকে ভারতের শিলং।  আবার তামাবিল থেকেই মেঘালয়ের পাহাড় আর দর্শনীয় স্থান গুলো খুব পরিস্কার ভাবেই দেখা যায়। প্রকৃতির এই মজার রুপবৈচিত্র প্রতিবছর অগনিত দর্শনার্থীদেরকে টেনে আনে সিলেটে।

সিলেটের দর্শনীয় স্থান মাধবকুন্ড

সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলায় বড়লেখা উপজেলায় মাধবকুন্ড জলপ্রপাত অবস্থিত। বাংলাদেশে নতুন ঝর্ণা গুলো আবিস্কারের আগে মাধবকুন্ডই ছিলো সবার আকর্ষনের কেন্দ্র বিন্দু। 

২০০১ সালে ২৬৭ একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠা মাধবকুন্ড ইকোপার্কের ভেতর দিয়ে প্রায় অর্ধ কিলোমিটার হাটা পথের পর দেখা পাওয়া যাবে প্রকৃ্তির এই অপার রুপধারী জলপ্রপাতের। 

১৬২ ফুট উচু এই জলপ্রপাতের পাশেই নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে পরীকুন্ড নামের আরেকটি ঝর্ণা। 

মাধবকুন্ড ইকোপার্কে কেউ গেলে অনায়াসেই ১ দিন পার করে দিতে পারবে। চা বাগান, খাসিয়া পল্লী, শ্রী শ্রী মাধবেশ্বরের মন্দির,পান-সুপারীর বাগান, কমলা লেবুর বাগান সহো বিভিন্ন জাতের প্রানীকূল ও পক্ষীকূলের আবাস স্থান এই ইকো পার্ক। ভালো করে লক্ষ্য করলে জুম চাষের দেখা পাওয়াটাও আশ্চর্য জনক নয়। চৈত্র মাসের ত্রয়োদশীতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বারুনী স্নান ও মেলা এক অনন্য মাত্রা যোগ করে।

  • হাকালুকি হাওর

হাকালুকি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তর হাওর । সিলেট ও মৌলভিবাজারের প্রায় ৫ টি উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে চলা এই হাওর বাংলাদেশের অন্যতম মিঠা পানির আধার। ২০ হাজার হেক্টর জায়গার উপর অবস্থিত এই হাওর তার বক্ষে ধারন করেছে প্রায় ২৩৮ টি ছোট বড় বিল এবং ১০ টি নদী । শীতের অতিথি পাখিদের অন্যতম অভয় আশ্রয় এই হাওর। ধারনা করা হয় প্রায় ১০০ প্রজাতির মিলন মেলা হয় এই হাওরে। পাখিদের কলকাকলী, দিগন্ত ছোয়া জলরাশি ভ্রমন পিপাসুদের বার বার ডেকে আনে হাকালুকির তীরে।

উপরে উল্লেখিত জায়গা গুলো ছাড়াও সিলেটে রয়েছে জিতু মিয়ার বাড়ি, আলী আমজদের বাড়ি, সিলেট শাহী ইদগাহ, লক্ষনছড়া, শাহপরানের মাজার, ড্রিম ল্যান্ড পার্ক, লালখাল সহো আরো অনেক বিখ্যাত জায়গা যা ভ্রমণ পিপাসুদের ভ্রমন পিপাসা মিটাতে পারবে অনায়াসেই।